লেখকের মৃত্যু
নির্ভীক-নির্মোহ লেখক হিসেবে খ্যাতি থাকলেও মনে মনে তিনি অনেক ভিতু।
খুব বুদ্ধিমান মানুষও মনের অতলে দু-একটা কুসংস্কার বহন করে। এই লেখক চারপাশেই কুসংস্কার দেখতে পান। না, লেখক হিসেবে সামাজিক কুসংস্কার তাঁকে অতটা ভাবায় না, যতটা ভাবায় নিজের কুসংস্কার। চারপাশে ঘটমান সবকিছুর সঙ্গে সবকিছুর একটা কাকতালীয় সংযোগ তিনি টের পান। অথচ তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই সংযোগগুলোর যৌক্তিক ভিত্তি কী, বলতে পারবেন না। কেউ যদি বলে ঘটনাটা আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু কী এবং কীভাবে বুঝতে পেরেছি বলতে পারছি না, তাহলে মুশকিলই। ধরা যাক, মৌমাছির কথা। কয়েক দিন ধরে তাঁর ঘরে ক্রমাগত একটা মৌমাছি ওড়াউড়ি করছে। একটাই ঘুরেফিরে আসছে নাকি পর্যায়ক্রমে একেকটা আসছে, বোঝা যাচ্ছে না। একদিন তাঁকে হুলও ফুটিয়েছে। মৌমাছির হুল ভয়ানক, এক দিন জ্বরে ভুগতে হয়েছে। কাঁধের কাছটা ফুলে আছে এখনো। তাঁর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন বলছে, এই মৌমাছি তাঁর সাম্প্রতিক রাইটারস ব্লকের কারণ।
আশপাশে কোথাও মৌমাছি চাক বেঁধেছে কি না, তিনি খুঁজেপেতে দেখেছেন, পরিচিত দোকানপাটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। চাকের কোনো খবর পাননি। আর চাক বাঁধবে কী করে? গাছ কই? তাঁর ভাড়া বাসার ছাদে উঠে চারদিকে তাকালে বহুদূরে একটা কী যেন গাছের আভাস দেখা যায়, কিন্তু গাছ কি না, নিশ্চিত হওয়া যায় না। এমন পরিবেশে মৌমাছির চাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। বারান্দায় তাঁর স্ত্রীর শখের দু-তিনটি নয়নতারাগাছ আছে। এই গাছে কি আর মৌচাক হবে? তাঁর স্ত্রী থাকলে অবশ্য বলতে পারতেন। এই নারী বিয়ের আগপর্যন্ত গ্রামে কাটিয়েছেন। গাছপালা সম্পর্কে সহজাতভাবেই তাঁর চেয়ে বেশি জানেন। আপাতত তিনি বাবার বাড়িতে আছেন। মৌচাক নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করার মানে হয় না।
বিগত দেড় দশকে লেখক সাহেবের বয়স বেড়েছে, পরিচিতিও; আর সেই সঙ্গে নতুন নতুন কুসংস্কার যুক্ত হয়েছে। মৃত্যুর আগে আগে তিনি একটি কুসংস্কারের এনসাইক্লোপিডিয়া লিখে যেতে পারবেন বলে মনে হয়। এই দেড় দশকে সবচেয়ে বড় যে কুসংস্কারটা তাঁর মনে বাসা বেঁধেছে, তার নাম তিনি দিয়েছেন ‘ক্রমিক-কপাল’। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তিনি লক্ষ করেছেন, এ দেশে একটা বড় ঘটনা ঘটলে সেই একই রকম কয়েকটা ঘটনা পরপর ঘটে। এ ধরনের ঘটনাগুলো সাধারণত বীভত্স হয়ে থাকে, ভালো কোনো ঘটনা একটা অন্যটাকে অনুসরণ করে না। হঠাৎ আগুন লেগে বড় কোনো কারখানা জ্বলেপুড়ে অসংখ্য প্রাণহানি হলে এর ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় একই ধরনের আরেকটা ঘটনা ঘটবে—এবার হয়তো কোনো শপিং কমপ্লেক্সে। এরপর কোনো ফ্ল্যাট বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হবে। খুব সম্ভবত বার্ন ইউনিটে বাবা-মা মারা গিয়ে বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে যাবে। এরপরের টার্গেট কোনো খানদানি রেস্তোরাঁ, যেখানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই। দুই মাস আগে হাতিরঝিলে ডুবে একটি শিশু মারা গেল। তারপর থেকেই অনলাইন আর প্রিন্ট মিডিয়ায় কেবলই পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর—পিকনিকে গিয়ে স্কুলছাত্র ডুবে মরল, নৌকাভ্রমণে গিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার সলিলসমাধি, নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে পুকুরে পড়ে পাঁচ বছরের শিশু নিহত। এ ঘটনাপরম্পরা লেখক সাহেবকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। তিনি লেখালেখির মালমসলা পান, তবে ভয়ও পান। লেখক হলেও মানুষ তো, তার ওপর মনটা তাঁর ভীষণ সংবেদনশীল। কেবলই মনে হয়, এরপরেই তাঁর পালা। হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়, ক্রমাগত ঘামতে থাকেন।
তিনি জানেন এসব মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। প্যানিক অ্যাটাকের জন্য তাঁর উচিত কাউন্সেলিং নেওয়া, নেন না। এ অসুস্থতাই তো তাঁর লেখার উত্স, সবই যদি স্বাভাবিক মনে হবে তো লিখবেন কী? শিল্পীরা সাধারণত নিঃসঙ্গ হন। অনেক মানুষের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ থাকতে পারে, প্রচুর কথাও হয়তো বলতে হয়, কিন্তু নিজের মনের নিগূঢ়তম ভয়কে খুলে দেওয়া যায়—এমন মানুষের দেখা সাধারণত তাঁরা পান না। পরম সৌভাগ্য যে লেখক সাহেব তা পেয়েছেন। একটিমাত্র মানুষের কাছেই তিনি নিজের ভয়ের কথা বলতে পারেন—তাঁর অফিসের বার্তাবাহক মান্নান। ‘পিয়ন’ শব্দটা লেখক সাহেবের কাছে শ্রুতিকটু লাগে। শব্দটার মধ্যে কেমন একটা ক্রীতদাস-ক্রীতদাস ভাব আছে। মান্নান লোকটা তাঁর চেয়ে যুক্তিবাদী। কিছু একটা সান্ত্বনা সে লেখককে দিয়ে দেয়। অথচ এই লোকটাকে হয়তো কোনোকালে কেউ চিনবে না। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে স্রেফ গায়েব হয়ে যাবে তার সব যুক্তিসমেত।
আজকেও লাঞ্চ আওয়ারে তিনি মান্নানের সঙ্গেই খেতে বসলেন এবং আবারও বললেন বিগত দেড় দশকের ভয়ের কথা। মান্নান খাওয়া থামিয়ে একান্ত মনোযোগে লেখক সাহেবের কথা শুনল এবং দুই আর দুই চারের মতো সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘কাহিনি হইছে কী, স্যার, একটা ঘটনা যখন আপনেরে গুঁতা দেয়, তখন ওই রকম সব খবরের দিকেই আপনের মনোযোগ যায়। আসলে এই সব রোজই ঘটতেছে। পানিতে ডুবে মরা নতুন কিছু না, স্যার। আল্লাহ আপনেরে দেখায় যাতে আপনে লেখতে পারেন। সবই তাঁর ইচ্ছা।’
এত সহজ? লেখক সাহেব থতমত হয়ে যান, ‘আর আগুন? আগুন কি রোজ রোজ লাগে নাকি? তাহলে তো পুরো দেশই ছাইয়ের গাদা হয়ে যেত।’
‘ঢাকা শহরে মানুষ কত আর বাসাবাড়ি কত জানেন, স্যার? সপ্তাহে একটা তলায় আগুন লাগলেও ছাইয়ের গাদা হইতে ১০ বছর লাগব। সব আগুনের খবর কি আর আমরা পাই? বহুত মানুষ মরলে পরে সাংবাদিকেরা খবর পায়, তারপরে আমরা। আর একখানে আগুন লাগলে অন্যখানে প্ল্যান কইরা আগুন লাগায়া দখলদারি চলে। আগুনও স্যার পলিটিকসের বাইরে না। তয় বেশির ভাগ মানুষ একদিন পরে ভুইলা যায়। আপনে ভোলেন না। মনে হয় লেখালেখি করেন দেইখ্যা। ভুইলা গেলে লেখবেন কী?’
মান্নান আঙুল চাটতে চাটতে এত সহজভাবে কথাটা বলল, লেখকের বুক হালকা হয়ে গেল। ধ্বংস আর মৃত্যুর মতো স্বাভাবিক পৃথিবীতে আর কী আছে? এই দুটো ব্যাপারকে যারা সহজে নিতে পারে, তাদের তাঁর হিংসা হয়। এই লোকটা যে চা-পাতা আর ফটোকপির বাজেট থেকে টাকা সরিয়ে ফেলে, বিশ্বাসই হতে চায় না। মান্নানকে নিজের সঙ্গে সব সময় রাখতে পারলে ভালো হতো। মনটা সহজে হালকা রাখা যেত। আর সত্যিই, ঢাকা শহরে বস্তিটস্তিসহ কত ঘরবাড়ি আছে, তিনি তো জানেন না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে লেখার জন্য তাঁর খ্যাতি আছে, অথচ এদের কারও সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা নেই। তাঁর তো উচিত শহরের গলিঘুপচিতে ঘোরা, সাধারণ মানুষের আলো-অন্ধকার দেখা। মান্নানকে কথাটা বলতেই সে বলল, ‘জে স্যার, সম্ভব। ঝাড়ুদারগো পকেটে অহন কোটি কোটি টাকা। বস্তিতে তারা থাকে না। তয় যারা থাকে, তারাই আসল গরিব স্যার। চলেন একদিন দেহামুনে। স্যার, আগুন লাগার খবর তো মেলাদিন পাই না। অহন আবার কী নিয়া ডরাইলেন?’
‘মৃত্যু নিয়ে।’
‘মরণরে তো সবাই ডরায়, স্যার। কুত্তাও ডরায়।’
‘আগুনের মতো মৃত্যু শুরু হয়েছে দেখেছ?’
‘না, স্যার। কাহিনি কী?’
‘দেশে শিল্পীরা মরতে শুরু করেছে। একজন গায়ক গলার ক্যানসারে মরল, একজন পেইন্টার আত্মহত্যা করল, একজন বেহালাবাদক ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করল, একজন অভিনেত্রীকে তার প্রেমিক গলা টিপে মারল। গত দেড় মাসের মধ্যেই এত।’
‘আপনেও মরবেন ভাবতাছেন?’
‘হুঁ। লেখক এখনো কেউ মরেনি।’
‘স্যার, মরার মতো লেখক কি হইছেন? হইলে মরবেন। অসুবিধা কী? আল্লাহ যদি মরণ লেখে তো কী করবেন?’
‘সেই তো সমস্যা, মান্নান। ভবিতব্যে বিশ্বাস করতে পারি না যে।’
‘কী যে কন, স্যার! এই যে বিশ্বাস করতাছেন যে একটা ঘটনা ঘটলে ঘটতেই থাকবে, এইটাই নিয়ম, এইটা ভাগ্যে বিশ্বাস না?’
‘হুঁ। একরকম তাই।’
মরার মতো লেখক কি হইছেন?—মান্নানের প্রশ্নটা সেই মৌমাছির হুলের মতোই তাঁর ডান চোখের পেছনে যেন বিঁধতে থাকল। যারা মরেছে, প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে বড় শিল্পী—জনপ্রিয়তায় নয়, যোগ্যতায়। গলার ক্যানসারে মৃত গায়ক উপমহাদেশের অন্যতম রাগসংগীতজ্ঞ বলে পরিচিত। যে দরিদ্র আঁকিয়ে আত্মহত্যা করলেন, তিনি ৪০ বছর সাধনার পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছিলেন। সংবাদপত্র বলছে, দুই মাসের মধ্যে প্যারিসে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হওয়ার কথা। অখ্যাত অবস্থায় ছবি এঁকে গেলেন আর হাততালির শব্দ শোনামাত্রই নিজের হাতের রগ কেটে দিলেন! বিষয়টা কী? ওই বেহালাবাদকের মতো বেহালা কয়জন বাজাতে পারে, সেটা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। কেন মৃত্যু তাঁকে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে কেড়ে নিল? ঘুমের মধ্যে তিনি কি স্বর্গে বেহালা বাজানোর স্বপ্ন দেখছিলেন? আর ওই ‘সিলেকটিভ’ অভিনেত্রী! একেক সিনেমায় একেক চরিত্রে একেক চেহারা একেক মেজাজ। সবাই যে একজনই, তাঁকে না চিনলে কেউ বলতে পারবে না। অভিনেত্রী হয়েই জন্মেছেন যাঁরা, তিনি তাঁদের একজন। কিন্তু হায়, তিনি কার যেন প্রেমে পড়েছিলেন। ভালোবাসার ক্ষেত্রে আর ‘সিলেকটিভ’ থাকতে পারেননি। হয়তো ওই একটি চরিত্রে তিনি অভিনয় করতে পারেননি বলেই মরে যেতে হলো। অথচ শত শত সস্তা-জনপ্রিয় গাইয়ে-অভিনয়শিল্পী-আঁকিয়েরা চমত্কার সুস্থ বেঁচে আছে, বুকভরা তাঁদের কত স্বপ্ন!
লেখক সাহেব একই সঙ্গে বাঁচতে চাইলেন এবং গৌরবান্বিত হতে চাইলেন। সুশিল্পীরা মারা যাচ্ছে, এই লগ্নে মরে গেলে পরে বড় লেখকের তকমাটা আরেকটু মজবুত হয়। সংবাদপত্র আর ফেসবুকেও লেখা হচ্ছে, ‘মহান শিল্পীদের অকালমৃত্যু’ বা ‘নিজেকে অমর করে মারা গেলেন অমুক শিল্পী।’ না মরলে কি অমর হওয়া যায়? ভবিষ্যতে কি আবার এই মৃত্যুর সুযোগ আসবে? আরেকটা উপন্যাস মরার আগে লিখে যাওয়া উচিত না? নাকি লেখকদের জন্য আলাদা করে মৃত্যুমৌসুম আসবে?
নিজের মন ভুলিয়ে রাখার জন্য লেখক সাহেব এলোমেলোভাবে ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করলেন। নাচ-গান, সিনেমার বিজ্ঞাপন, মিম, ট্রল—কোনো কিছুই তাঁকে মৃত্যু থেকে বিচ্যুত রাখতে পারল না। চোখ যখন ক্লান্ত হয়ে এসেছে, তখনই মৌমাছি তাঁকে মৃত্যুর আরও কাছাকাছি নিয়ে এল। আন্তর্জাতিক কোনো এক জার্নালের গবেষণার ফলাফল বলছে, মৌমাছি না থাকলে বিশ্বের ৭০ শতাংশ প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরাগায়ন বন্ধ হয়ে ফল-ফুল জন্মানো বন্ধ হবে। ফসল ফলবে অর্ধেক। এমনকি বিশ্বসেরা রাসায়নিক সার বা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়েও ফসলের মনোরঞ্জন করা যাবে না। প্রতিবেদনের শেষ বাক্যটি এমন, ‘প্রাণের দায়ে লেখক যেভাবে অক্ষর দিয়ে চরিত্রের সাথে সুবিচার করে, সেভাবেই মৌমাছিরা আমাদের খাদ্যের বরাদ্দ লিখে যায় গাছ, ফসল আর ফুল-পল্লবে।’
লেখক সাহেবের বাঁ চোখের পেছনে ভবিষ্যৎ ঝলসে উঠল। মোটরবাইক ভাড়া করে যথাসম্ভব দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে চাইলেন। আজ অবশ্য রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থা তাঁর অনুকূলেই। বাসায় ঢুকেই তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন। মনে হচ্ছে খুঁজে না পেলে তাঁকে আত্মহত্যা করতে হবে। এভাবেই বোধ হয় তাঁর জীবন শেষ হবে। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল। ডাইনিং টেবিলের তলায় গোবদা সেই মৌমাছিটার মৃতদেহ পড়ে আছে, পিঁপড়ায় ছাওয়া।
এক গ্লাস পানি খেতে খেতে মৌমাছিকে লেখক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া সেই প্রতিবেদক বেঁচে আছে কি না, তিনি ভাবলেন।
No comments